বৃষ্টিতে ঢাকা রিকশায়

Reading Time: 2 minutes

সকাল সকাল অফিস যাবো বলে বের হলাম। ধানমণ্ডি স্টার কাবাবের সামনে রিকশায় ওঠার পরেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ছাঁট নামলো। ধানমণ্ডি ৪ এর কাছাকাছি যেতেই তার বেগ আরো বাড়লো।

হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় সবুজ গাছেরা নড়ে উঠল। এক পলকের ফ্ল্যাশব্যাকে দেখি আমি ১৯৯৭ সালে, ক্লাস ফোরে পড়ার সময়, এই রাস্তা ধরেই যাচ্ছি গ্রিন রোডে – YWCA স্কুলে ক্লাস করতে।

তখনকার অদ্ভুত এক মায়াময় পৃথিবী ছিলো। বিটিভির প্যাকেজ নাটকে তৌকির-বিপাশা, টনি ডায়েস, আফসানা মিমি, শমী কায়সার, নোবেল, মৌ, জাহিদ হাসানদের প্রায়ই দেখা যেত রমনা পার্কের বেঞ্চে কিংবা ভেতরের চাইনিজটাতে। কপিরাইটের টেনশন না নিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতো Careless Whisper।

আজকের মত কাতুকুতু দেয়া লাউড ছিলো না প্রেমের নাটকগুলি, চৌকস নায়ক-নায়িকার ছোট ছোট খুনসুটিগুলোতেই হেসে খুন হতো বাসার সবাই।

সেসব নাটকে বৃষ্টির দিনগুলো দেখতে আজকের মতই ছিল। রাস্তাঘাট একটু বিবর্ণ কিন্তু গাছগুলি গাঢ় সবুজে প্রাণবন্ত, বাতাসে মাঝে মাঝে দুলে উঠছে হাল্কা মাতালের মত। সেই নব্বই দশকের DV ক্যামেরার ঘোলা প্রিন্টের প্যাকেজ তবু নাটকগুলি আজকের HD প্রিন্টের চাইতেও মনোহর মনে হত।

আমাদের সিদ্ধেশ্বরীর রোডের বাসায়, বৃষ্টির বাতাসে, ছয় তলায় উঠে আসা অবাধ্য বাতাসের দম মন ভিজে উঠত। দুপুরবেলায় টিভিতে দেখার মত কিছু না পেয়ে তিন গোয়েন্দার কিশোর, মুসা, রবিনের সাথে সময় কাটানো হত।

সন্ধ্যায় বাবা মায়ের সাথে নাস্তার টেবিলে বসা হত। তাদের গায়ের চামড়ায় বয়সের ভাঁজের ছিটেফোঁটা নেই, বাবাকে যত শক্তিশালী, মাকে কতই মমতাময়ী মনে হত। খুশিমনে ধোঁয়া ওঠা পিঁয়াজুতে কামড় দেয়া, ছোট বোনের ভাগের পিঁয়াজু ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলত। বোতলে আটকে থাকা টমেটো কেচাপকে নানান কায়দা করে প্লেটে ঢালতে হত (বোতল উলটা করে পিছনে জোরে থাপ্পড় দিলেই একটা “থ্যাপ!” আওয়াজে বেশ কিছুটা লাল কেচাপ চ্যাটকে যেত প্লেটে)।

বাসের বাসার ক্যাসেট প্লেয়ারে ভেসে আসতো Warfaze এর “বৃষ্টি নেমেছে…”

কর্কশ, প্যাঁ-বর্গীয় একটা হর্নের সাথে হঠাৎ কানের পর্দা ধাক্কা খেলো, খেয়াল ফিরে আসলো ঢাকার ট্রাফিকে। প্রায় চলে এসেছি সূর্যের হাসি সাইনবোর্ডওয়ালা গলির কাছাকাছি। অফিসে ঢুকতেই সারাদিনের কাজের লিস্ট সামনে, হাল্কা ভেজা গাত্রে কলিগদের আগমন একে একে।

এত কাজের ভিড়েও এইটুকু স্মৃতিকে শেয়ার করার লোভ সামলানো গেলো না। বসে গেলাম ল্যাপটপে। সত্যিই অপরুপ কিছু সময় পেয়েছি শৈশবে, তাদের পাথেয় করেই আজকের পথচলা। ❤

_____

২০২৩ এ বসে ২০২১ এর এই লেখাটা পড়ে কেমন মনে কেমন যেন মোচড় দিলো। ২০২২ এ ঢাকা ছেড়ে আমি অটোয়ায়। এখানকার বৃষ্টিতে নেই সেই মোলায়েম ভাব, রাস্তায় বেজে ওঠে না কোন রিকশার টুংটাং।

সাদা বরফে ঢাকা এই দেশও হাতছানি দেয়, “আমাকে তোমার দেশ বলে মেনে নেবে?”

তা তো এখনো বলতে পারি না ঠিক করে। দেশ কি শুধু ওই বর্ডার আঁকা ১৪৭৫৭০ বর্গ কিমি এর জায়গাটুকু, নাকি ‘৭১, ‘৪৭ এর আগের হাজার হাজার বছরকেও হিসেবে আনবো, নাকি ওই বর্ডারের ভেতরে রেখা আসা মানুষগুলো, নাকি যে অতীতে আমি বেড়ে উঠেছি যে মানুষগুলোর সাথে তারা, অথবা এই সবের একটা সামষ্টিক অস্তিত্ব?

তা জানি না, অত দার্শনিকতার সময় আপাতত ঝোলায় নেই, যে ভেবে বের করব। আমি মুসাফির, সামনে পথ, মনের গভীরে এক গন্তব্যের স্বপ্ন নিয়ে চলছি। গন্তব্য না, যাত্রাটাকেই যাতে ফোকাসে রাখি।

এই বরফ বিছানো পথও সেই যাত্রার অংশ, এই পথেও সেই পাথেয় নিয়েই চলতে থাকবো। অটোয়ার কর্কশ কিংবা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ইয়ারফোনে বাজতে থাকবে ‘আজ ঝড় ঘনঘটা আনন্দ মেঘে ঢাকা’, অথবা ‘Sawan barse tarse dil’ কিংবা ‘বৃষ্টি দেখে অনেক কেঁদেছি, করেছি কতই আর্তনাদ… মেঘের ডানায়, কাটিয়ে দিলাম, আমি হাজার বর্ষা রাত!’

 [ঝোলায় সময় জমলে এই টপিকের ওপর কিছু ভাবনা তর্জমা করার ইচ্ছে আছে, লেখা হয়ে গেলে এখানে লিঙ্কটা দিয়ে দিব।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *