চলে গেলেন মিতু মামি

Reading Time: 3 minutes

গাঢ় কষ্টের একটা সংবাদ দিয়ে বছরটা শুরু হল।

আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহস ও মোটিভেশন দেয়া মিতু মামি আর নেই। সাহিত্যানুরাগী, মিষ্টভাষী, অনেক অনেক আন্তরিক এবং সহানুভূতিশীল মানুষটা আমার জীবনে অনেক সিগনিফিক্যান্ট হয়ে থাকবেন।

শুরুর গল্প

ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় চিটাগং থেকে কুমিল্লায় গিয়ে আমি খুবই চুপচাপ, ইন্ট্রোভার্টেড হয়ে গেসিলাম।

বাবা মা ডাক্তারি পেশার প্রেশারে ব্যস্ত, আমি আমার বোন এপ্রিসিয়েশন পেতাম পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার পর। যতটা না টাইগার প্যারেন্টিং, তার চাইতে বেশি তাদের পেশাগত দায়বদ্ধতা।
তবে এটাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, পড়াশোনা করব, পরীক্ষা দেব, এরপর কিছু প্রশংসা কামাব। এরপর আবার পড়াশোনা।

মিতু মামি অনেক বড় একটা চেঞ্জ আনলেন।

আমাদের জীবনে মিতু মামির প্রবেশ

আমরা ঢাকায় আসলাম যখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। মামি মাস্টার্সের শেষ পরীক্ষা দিয়ে ঘরে ঢুকেছেন আর আমার জাকির মামার সাথে বিয়েটা হয়েছে।
বিয়ের পর মামি ঢাকার বাসায় আসলেন। এবং দুই দিন আমাকে অবজার্ভ করে রীতিমত ঘোষণা করলেন, আমি এক অসাধারণ মানুষ এবং আমার মত কাউকে নাকি তিনি কখনোই দেখেন নাই। আমি একদিন অনেক বড় কিছু করব।

পরীক্ষার রেজাল্ট ছাড়াও প্রশংসা পাওয়া যায়? চুপচাপ শান্ত বালকের চোখে পানি চলে আসে। সিদ্ধেশ্বরী রোডের ছয়তালার ফ্ল্যাটে ভেসে আসা দমকা হাওয়ায় নিজের বুকে একটা সাহস পাই, চুপি চুপি যেন বাতাসও বলছে, তুমি এক বিস্ময় বালক। হাহাহা।

বুকের ভেতর অজানা আশ্বাস, আসলেই আমাকে নিয়ে দেখা বড় বড় স্বপ্নগুলি পূরণ করতে পারবো একদিন?

একদিন অংক ক্লাসের হোমওয়ার্কে খুব কঠিন অঙ্ক থাকায়, সল্ভ করতে পারছিলাম না। মামির কাছে গেলাম। মামিও অনুতপ্ত স্বরে জানালেন, এই প্রশ্নগুলির উত্তর তাঁর কাছেও নেই। কিন্তু কয়েকদিন আমাকে চুপচাপ বই পত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখে, আর আমার সাথে কথাবার্তা বলে, মামি আমার ভূয়সী প্রশংসা করা শুরু করলেন।

মামির খুব মিষ্টি, আন্তরিক কণ্ঠস্বরে করা প্রশংসাগুলো আমার আত্মবিশ্বাসের পাল ফুলিয়ে মেলে দিল । তারপর আজ ২৪ বছর হয়ে গেছে, এখনো সেদিনের কথা ভাবলে মোটিভেশন পাই।

বড় হবার সাথে সাথে মামির প্রশংসা বাড়তেই থাকে। মামা স্পেনে থাকতেন, মামিও মুভ করলেন কিছুদিন পর। ফোনে খোঁজ নিতেন। প্রশংসা করতেই থাকতেন। সবাইকে বলতেন, রবি (আমার ডাক নাম) অনেক স্পেশাল।
মামির বড় ছেলের নাম আমার আর আমার ছোট বোনের নামের সাথে মিলিয়ে, ধ্রুব রাখলেন। আমাদ্রে নাম রবি-শশী, আর ধ্রুবতারা থেকে ধ্রুব।

ফিল্মমেকার হবার পথে মামির অপ্রত্যাশিত সাপোর্ট

আমার ফিল্মমেকিং এর আগ্রহ নিয়ে আমার বাসায় কারো তেমন আগ্রহ ছিলো না। খুব ডিপ্রেশনে দিন কাটতো। স্পেন থেকে বেড়াতে আসার সময় মামি একটা ছোট ক্যামেরা নিয়ে আসলেন, যেটাতে কয়েক মিনিটের ভিডিও করা যেত। আবারো সাহস পাই, ছোট্ট গ্লাসের মাঝে জিইয়ে রাখা ছোট্ট মাছের মত নিজের স্বপ্নটাকে জিইয়ে রাখি। একদিন সত্যি সত্যি ছোট মাছ বিশাল তিমি হয়ে ওঠে, পা রাখি লন্ডনে, ফিল্মের ছাত্র হিসেবে।

যখন আমার দুর্দিন আসে, স্বপ্নপূরণে ব্যর্থ হই, মামি হতাশা দেখাননি। আমার অক্সফোর্ড গ্র‍্যাজুয়েট কাজিনকে তিনি যতটা পারদর্শী ভাবেন, তাঁর চাইতেও আমাকে নিয়েই তাঁর বেশি প্রত্যাশা! এ কেমন বিশ্বাস?

জানিনা কি কারণে মামি এতটা করতেন আমার জন্যে। অদৃশ্য একটা মায়ার বাঁধন, যেটার এক প্রান্ত এখন পরপারে। আরেক প্রান্তে আমার রক্তাক্ত হৃদয়।

মামির বই পড়ার নেশা

মামা মামির আরেকটা ছেলে হয়, মুস্তাকিম। একসময় লন্ডনে মুভ করেন। তাদের বাসায় যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। মামি দেশ থেকে প্রচুর বই নিয়ে আসতেন। প্রিয় কবি বোধহয় হেলাল হাফিজ। হুমায়ুন, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, সুনীল, বিভূতিভূষণ, শরৎ সহ আরো অনেক অনেক লেখকের বই পড়েছেন। ইংরেজি অনুবাদও হয়তো পড়তেন, তা নিয়ে বেশি আলাপ হয়নি।

মামা দেশে আসলেই মামি একটা বইয়ের লিস্টি দিয়ে দিতেন। কোনোটা সেই লিস্টি থেকে মিস হয়ে গেলে, ফোন করে বলতেন, এগুলোও নিয়ে এসো।

আমার বাবার ফেসবুকে লেখা স্ট্যাটাসগুলিতেও মামি উৎসাহ দিতেন।

তাদের বরিশালের বাড়িতে একটা চিলেকোঠা ছিল। সেই চিলেকোঠায় উঠতে হত কাঠের তৈরি একটা হেলানো সিঁড়ি চার হাতপায়ে বেয়ে। যতদূর মনে পড়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যেত না। কিন্তু আরাম করে বসে বই পড়া যেত। বইপোকা মিতু মামি নিশ্চয়ই লন্ডনে বসে অনেক মিস করেছেন সেই জায়গাটা। হয়তো আরেকবার যেতে চেয়েছিলেন। তা আর হলো না।

আমার মামা আর দুই ভাইয়ের সাথে এখনো কথা হয়নি। কি বলবো এখনো জানি না।

মামির চলে যাওয়া

একটা খারাপ অসুখ ধরা পড়ে মামির আরো বেশ কবছর আগে। একটু একটু করে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ছিল। এর মাঝেও মামির ভাই – আমার তুহিন মামা, ও বোন – তুলি খালা, মামির বাবা মাকে নিয়ে মামি খুব ভাবতেন। মামির ছোট বোন – আমার তনা খালা, অল্প বয়সে মারা যান – তাকেও মামি খুব মিস করতেন।

মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু তবু আমরা দীর্ঘজীবী হই অন্যের মনে জায়গা করে নিয়ে। মিতু মামি চলে গিয়ে আমাকে শেষবারের মত মনে করিয়ে দিলেন। আজীবন তাঁকে মনে রাখবো, আমার ওপর রাখা তাঁর গভীর আস্থা আর বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে যাবো।
আমার এ পর্যন্ত আসার পেছনে মামির অনেক অবদান। কোনদিনই ভুলবার নয়। কোনদিনই না।

আল্লাহ্‌ তাঁকে বেহেশত নসীব করুন। মামি হয়তো সেখানে সেই চিলেকোঠাটা পাবেন, তাঁর প্রিয় বইগুলি পাবেন। কোনোটা লিস্ট থেকে মিস হবে না। পাশে থাকবে এক কাপ কফি, যাতে একটা এক্সট্রা Kopiko ক্যান্ডি দেয়া থাকবে। মিতু মামি বসে বসে আয়েশ করে পড়বেন। পৃথিবীর কোন অসুখ তাঁকে আর কখনো স্পর্শ করবে না।

সবাই তাঁর জন্যে দোয়া করবেন।

And please don’t take people close to you for granted. Get in touch and appreciate them, before you miss the chance forever.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *