আমরা ছোটবেলা থেকেই শিখিঃ শিক্ষক ও গুরুজনদের কথা সবসময় মানতে হবে, সম্মান দেখাতে হবে। তাঁদের সাথে কখনই তর্ক করতে নেই।
কিন্তু এই কথা হুবহু অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিলে ব্যক্তিজীবনে এবং পলিসি পর্যায়ে বেশ কিছু সমস্যা হতে পারে।
কীভাবে?
প্রথম প্রসঙ্গঃ শিক্ষকদের প্রাপ্য সম্মান
একথা ঠিক যে, যেসব পেশায় শুধু টাকা ও প্রোডাক্টের লেনদেন হয় যেমন মুদি দোকানদারি – সেসবের চাইতে শিক্ষকতার পেশার প্রভাব সুদূরবিস্তারি। যেমন একজন প্রথম শ্রেণীর শিশুর মস্তিষ্কে, মনে, বা আচরণে শিক্ষক যে শিক্ষা, চেতনা, বা মূল্যবোধ প্রবেশ করিয়ে দেন তা ঐ শিশুর বাকি জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রাখে।
একটা জাতিকে অনুন্নত অবস্থান থেকে উন্নত অবস্থায় নিতে ভালো শিক্ষকদের অবশ্যই প্রয়োজন।
তাই লেনদেন নির্ভর পেশার চাইতে শিক্ষকতার পেশায় আলাদা মর্যাদা দেয়া হয়।
এতে উপকার এই যে, শিক্ষকেরা আরো সচেতন ও আন্তরিকভাবে স্টুডেন্টদের পড়াবেন।
এজন্যেই ছোটবেলায় সরকারি বাংলা মিডিয়াম শিক্ষা ব্যবস্থার ‘আমার বই’ নামের বইয়ে ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামের কবিতা পেয়েছিলাম।
কিন্তু, এই মর্যাদা কি ঢালাওভাবে প্রতিটি শিক্ষকদেরই দেয়া প্রয়োজন?
প্রথম প্রশ্নঃ সবাই কি প্যাশন থেকেই শিক্ষক হয়?
শিক্ষকের শেখাতে আসার পেছনে উদ্দেশ্য কি, সেটা বোঝা খুব দরকার। সবাই শেখানোর প্যাশন থেকে শিক্ষক হয় না।
কেউ হয় পেটের দায়ে। পেশা হিসেবে হয়তো এর চাইতে ভালো অপশন ছিলো না।
তাতে তো কারো অসুবিধা নেই। অনেক শিক্ষকই শুধু পেশা হিসেবে শুরু করলেও পরে নিজ দায়িত্বে দক্ষ ও কেয়ারিং শিক্ষক হয়ে ওঠেন।
উল্লেখ্য, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী শিক্ষকদের বৈশিষ্ট্যঃ
- ধৈর্য (সবর)
- সহানুভূতি ও সমবেদনা (রহমা)
- বিনয় (তাওয়াদু)
- জ্ঞান ও প্রজ্ঞা (ইলম এবং হিকমাহ)
- ন্যায়পরায়ণতা ও সততা (আদল ও সিদক)
- মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ও নমনীয়তা
- কৃতজ্ঞতা (শুকর)
সনাতন ধর্ম অনুযায়ী শিক্ষকদের বৈশিষ্ট্যঃ
- শান্তি
- আত্মনিয়ন্ত্রণ
- সহানুভূতি
- অন্যদের সাহায্য করার ইচ্ছা
এই ধরণের আচরণ কি সেই শিক্ষকেরা করেছিলেন, যারা রাজনীতির গোলাম হয়ে তাদের স্টুডেন্টদের লিস্ট তৈরি করে সরকারকে দিচ্ছিলেন? বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যত সন্ত্রাস, যত অত্যাচার হয়ে এসেছে ছাত্র রাজনীতির মোড়কে, সেগুলিকে আরো শক্তিশালী করে তুলছিলেন যারা, তারাও কি আদতে শিক্ষক?
বুয়েটে আবরার হত্যার পর ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা কি কিছু শিক্ষক করেননি? বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনতে কিছু শিক্ষক কি সচেষ্ট ছিলেন না? সাস্টের ভিসি ফরিদ উদ্দিনের মত মানুষেরা কি শিক্ষকতা প্যাশন থেকে করছিলেন, নাকি অর্থ ও ক্ষমতার লোভ থেকে?
এনাদেরকে প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে – এই কথা তোলার আগে, এনাদের সম্মানই প্রাপ্য কিনা, সেটাই তো একটা কঠিন প্রশ্ন!
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ সব শিক্ষকই কি ভালো মানুষ?
এমন একটা ক্যাটাগরির শিক্ষকদের কথা এখন বলব, যারা সংখ্যায় অনেক কম কিন্তু তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যাবে না। তারা শিক্ষক সেজে স্কুল,কলেজ, ভার্সিটি, বা প্রাইভেট কোচিং করায় কিন্তু ভেতরে একটা নরপিশাচ পালন করছেন। তারা কেউ মানুষ হিসেবে অতি হিংস্র, বা অতি লোভী, কিংবা যৌনতার বিষয়ে আগ্রাসী লাগামহীন এক জন্তু।
পরিমলের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। এরকম পার্ভার্ট শিক্ষকদের কি সম্মান দেখানো সম্ভব?
প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত যত শিক্ষক – এরা কি সম্মান পাবার যোগ্য?
স্টুডেন্টের পরিবার ভিন্ন রাজনৈতিক দল করেন বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী – এজন্যে স্টুডেন্টকে সব সময় অপমান করতে থাকা, তাকে পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়া শিক্ষক – তারা কি সম্মান পাবার যোগ্য?
বাসায় প্রাইভেট পড়াতে এসে যৌন হয়রানি করেছে – এমন শিক্ষকেরা কি সম্মান পাবার যোগ্য?
সম্মানিত শিক্ষকদের দলে এইসব মানুষকে স্থান দিলে, শিক্ষকতা পেশায় আছে বলেই, চোখ বুজে এদেরকে বিশ্বাস করলে, এরা ছাত্র ছাত্রীদের সারা জীবনের জন্যে ট্রমা দিয়ে দিতে পারে – শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে।
আরেকদল টিচার দেখেছি, নিজের কাছে কোচিং করলে সাতখুন মাফ অথচ যারা কোচিং করতো না তাদের বেধড়ক মারধর করতো। যাদের মারধর করলে বাবা মা কমপ্লেন করে দিবে, তাদের খুব খারাপ ভাবে অপমান করতো। এইসব টিচাররাই স্কুলের বুলি হয়ে উঠেন, এমনকি ক্লাসের বুলিদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখেছি। বলাই বাহুল্য, এই বুলিরা তার কাছে প্রাইভেট পড়তো।
এনাদের কখনোই ভালো মানুষ বা ভালো শিক্ষক বলা যাবে কি?
তৃতীয় প্রশ্নঃ একজন শিক্ষক যে বিষয়ে দক্ষ, তার সেই বিষয়ের মতামতকে গুরুত্ব দিবো, স্বাভাবিক। কিন্তু যদি কেমিস্ট্রির টিচার ভূগোল নিয়ে মতামত দেন, তখন তো একটু খতিয়ে দেখতে হবে, তাই না?
দেখুন, বাংলাদেশে বেশ কিছু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকার, উঁচুমানের শিক্ষক আছেন। তাঁদের জ্ঞানের পরিধি বিশাল। কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে, তাঁরা যেই বিষয়ে আন্ডারগ্র্যাড ও মাস্টার্স করেছেন, এর বাইরের গণ্ডিতে তাঁদের এক্সপার্টিজ এর প্রমাণ ছাড়া, আমরা কেন তাঁদের প্রতিটি কথাতেই অন্ধবিশ্বাস করব?
প্লিজ খেয়াল করে দেখুন, প্রাইমারি স্কুল বা হাই স্কুলে শিক্ষক সংকটের জন্যে এক শিক্ষক কয়েকটি বিষয় পড়ান। আমি এর বিরুদ্ধে কিছু বলছি না। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ও জনসংখ্যা অনুযায়ী বর্তমানে এই ব্যবস্থাই টিকিয়ে রাখতে হবে।
তাই বলে, পৃথিবীর সব রকম বিষয়েই যে এখন শিক্ষকের সর্বোচ্চ জ্ঞান থাকবে, সেই সার্টিফিকেট তারা কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন?
আমি কানাডায় এসে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককেও পাই নি, যিনি দাবি করেছেন যে, তিনি যে বিষয়ে পিএইচডি করে এত বছর পড়াচ্ছেন, সেই বিষয়ে তিনি সব জানেন। বরং তাঁরা জ্ঞানের ভারে যেন আরো ন্যুব্জ হয়ে আছেন। যেমনটা হয় ফলদায়ী গাছের ক্ষেত্রে।
করণীয়ঃ
তাই প্রথম থেকেই, এই শিক্ষক কি মানুষ না মানুষরূপী জন্তু, তা নিয়োগের আগেই যাচাই করতে হবে। এবং সিস্টেমেটিক্যালি, রিক্রুটমেন্ট থেকে শুরু করে বার্ষিক রিভিউ প্রসেসের মাধ্যমে নরপিশাচদের শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করা বা দশকের পর দশক টিকে থাকাকে ফিল্টার আউট করতে হবে।
এখানে ভাবা যেতে পারেঃ
১। রিক্রুটমেন্টের সময় পার্সোনালিটি টেস্ট।
২। ক্রিমিনাল রেকর্ড চেক। তার বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে কোনো ধরনের যৌন হয়রানির উদাহরণ আছে কিনা তা দেখা।
৩। বার্ষিক ৩৬০- পিয়ার রিভিউ (খরচ কমানোর জন্যে, গুগল ফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী অজ্ঞাত থেকে সার্ভেতে শিক্ষককে ফিডব্যাক দিতে পারে, যা সার্ভে শুরু হবার ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে শিক্ষকের কাছে পৌঁছানো হবে।)
৪। শিক্ষকদের কন্টিনিউয়াস লার্নিং নিশ্চিত করা, প্রতিবছর তাদের নিজস্ব লার্নিং প্ল্যান মেন্টেন করা। (তবে এইটা ইমপ্লিমেন্ট করা কঠিন হবে।)
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত একটি ব্লগ অনুসারে শিক্ষকদের করণীয়ঃ
- শিক্ষার্থীর পরিচয় জানুন এবং তারা কী বিষয়ে আগ্রহী তা বুঝুন।
- কীভাবে ভালোভাবে শিখতে হয় তা মডেল করুন।
- শিক্ষার্থীদের উপর ফোকাস করুন; সহানুভূতিশীল ব্যবহার করুন।
- শিক্ষার্থীদের সাথে একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলুন যাতে তারা আরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
- আপনার শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব সহকারে নিন।
- তাদেরকে সুচিন্তিত এবং গভীর চিন্তার যোগ্য মানুষ হিসেবে বিবেচনা করুন।
- পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত চিন্তা করতে এবং তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হোন।
- শেখার প্রতি ভালবাসা রাখুন।নিজেকে মূল্যায়ন করুন এবং প্রতিফলন করুন।
- আপনি কীভাবে যোগাযোগ করছেন তা খেয়াল করুন। কণ্ঠের সুর গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গঃ গুরুজনের সব কথাই কি মানতে হবে?
গুরুজন – বলতে কেবল গুরু নয়, পুরো সিনিয়র সমাজ, অর্থাৎ আপনার চাইতে ১ বছরের বা কয়েক মাসের বড় এমন সবাইকেই ধরা যেতে পারে। অর্থাৎ ৯ বছরের এক ছেলের কাছে তো ১০ বছরের পিচ্চিই তো গুরুজন হয়ে ওঠে।
এটা হয়তো ভাবতে হাস্যকর লাগছে কিন্তু কিছু প্রত্যন্ত এলাকার ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে দেখুন, থার্ড ইয়ারের ছেলেপিলে ফার্স্ট ইয়ারের সাথে এমনভাবে কথা বলছে, যেন তাদের এরমাঝেই পিএইচডি কমপ্লিট হয়ে গেছে! এবং ফার্স্ট ইয়ারদের মোটেই কোনো কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই!
“সিজিপিএ দিয়ে কি হবে?,” “ভার্সিটি লাইফে একটা প্রেম না করলে তা আবার কিসের ভার্সিটি লাইফ?,” “৩-৪টা টিউশনি করা, নিজের খরচ নিজে চালা, পার্ট টাইম ইন্টার্নশিপ দিয়া কি হবে?” “এখনই চাকরি বাকরি নিয়ে ভাবিস কেন? প্রথম দুইটা বছর শুধু আমাদের ক্লাবে টাইম দে, জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা,” ইত্যাদি নানান দৃষ্টি ভঙ্গি অনেক সিনিয়র তার জুনিয়রদের মধ্যে চাপিয়ে দেয়। অথচ ঐ জুনিয়রের জন্যে হয়তো ঐটা ভালো সাজেশন ছিলো না।
কিন্তু অনেক জুনিয়রই মেনে নেয়, অথবা কিছু বলে না, কারণ গুরুজন বলে কথা। আর ২০২৪ এর আগস্টের আগে তো রাজনীতির ছাতার ছায়াতেই অনেকে ক্যাম্পাসে গুরু সেজে বসতো। তখন তো আরো অসম্ভব ছিলো।
কেন শিক্ষক ও গুরুজনের কথাকে যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে ভাবা উচিৎ?
এই যে শিক্ষক বা গুরুজন বলেছেন তাই মানতেই হবে, এইরকম একটা অভ্যাসে দুইটা সমস্যা হয় গুরুজনদেরঃ
এক, গুরুজনরা কোন প্রকার রিসার্চ বা Due Diligence ছাড়াই কথা বলার লাইসেন্স পেয়ে যায়। এতে তাঁদের গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দেয়া কমে যায়।
দুই, গুরুজনরা তাদের জুনিয়রদের কাছ থেকে কোন প্রকার ক্রিটিক্যাল আর্গুমেন্ট পান না। এতে করে, তাদের নিজেদের জ্ঞানের ধারই কমে যায়।
আর জুনিয়রদের ক্ষতি?
গুরুজনের কথা যদি সবসময় মানতেই হয়, এবং মুখে মুখে তর্ক নাই করতে হয়, তখন, সিনিয়র ব্যাচের একজন স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন ছাত্র তার এক বছর পরে ভর্তি হওয়া জুনিয়র ব্যাচের সবচাইতে মেধাবী ছেলে মেয়েদের চুপ করিয়ে দিতে পারে।
মেন্টাল বা ফিজিক্যাল কষ্ট থেকে শুরু করে, যৌন হয়রানি, আর্থিক ক্ষতি – এমন উদাহরণ পত্রিকায় না আসলেও, বাংলাদেশে যারাই স্কুল কলেজে পড়াশোনা করেছেন, তাঁরা সবাই কমবেশি এমন কোনো না কোনো এবিউজিভ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শি।
আর সবচেয়ে কষ্টের সিচুয়েশোন হল, বাধ্য জুনিয়র ৫-১০ বছর বুঝতে পারে, সে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
এই ধরনের সম্পূর্ণ সাবমিসিভ আচরণের ফলে কীভাবে জ্ঞান অর্জন ব্যাহত হয়ঃ
একটা জিনিস খেয়াল করেন। এমন কি কখনো দেখেছেন যে, এক ব্যাচের ৯০% ছেলে মেয়ে মেধাবী আর তার পরের ব্যাচের ৫% মাত্র মেধাবী? এত বড় গ্যাপ হবার সম্ভাবনা কম থাকে। যদিও কোন accurate research নাই, তবে খেয়াল করলে দেখবেন যে, প্রতি ব্যাচে ১০-২৫% ছেলে মেয়ে খুব ট্যালেন্টেড হয়। Normal Distribution এর Bell Curve এর মত, বেশিরভাগ হয় মাঝারী মানের স্টুডেন্ট, আর কিছু অংশ থাকে যারা ঝরে পড়ে কিংবা একদম নিম্নমানের Understanding ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভার্সিটি শেষ করে।
By the way, নিম্নমানের গ্রেড কিন্তু বলছি না, নিম্নমানের understanding ও বুদ্ধিমত্তা বলছি। কারণ, ঐ স্টুডেন্টরা বাকিদের মত evolve করতে পারে নাই। কিন্তু তাদের সুযোগ এখনো আছে এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে তারাও বিজয় অর্জন করতে পারবে।
এতে ঐ সিনিয়র এবং ঐ জুনিয়র দুই পক্ষেরই লস!
কিন্তু নর্থ আমেরিকা, বা তুলনামূলকভাবে উন্নত যেকোন দেশেই যুক্তিসম্মতভাবে তর্ক করতে পারার বিশেষ মূল্য দেয়া হয়। তারা Critical Reasoning এর সঠিক চর্চার কারণে, তাদের পক্ষে বেস্ট ডিসিশন গুলি নেয়া সম্ভব হয়। তারা একটা প্রজেক্টের আইডিয়ার পাশাপাশি, এর রিস্ক, এবং রিস্ক এড়ানোর জন্যে কি কি করতে হবে তার ধারণা পায়।
এতো গেল ইউনিভার্সিটির কথা। এখন যদি অফিসের দিকে তাকাই?
কয়টা অফিস আছে বাংলাদেশে, যেখানে বসের ভুল ধরিয়ে দেয়া সম্ভব? সেরা কর্পোরেটগুলিতেও বসের একটা ছোট্ট ভুল বুঝিয়ে দেবার জন্যে আগে ৫ টা ভালো কথা পরে ৫ টা ভালো কথার বার্গার বানিয়ে এমনভাবে বলা হয়, যেন এটা বসের ভুল ধরানো হচ্ছে না, পুরো টিমেরই ভুল হয়েছে।
মানে, ১১ টা কথা বলে ১ টা ভুল প্রকাশ করা হয়। তাহলে Efficient Communication কিভাবে হবে?
আর এই বস তো ভেবেও নিতে পারেন, উনার কোনো ভুল হয়নাই। এটা টিমের ভুল ছিলো। তাহলে তো উনি ভবিষ্যতে আবার এমন ভুল করবেন!
হবে না, কারণ Culture eats strategy for breakfast, এবং বাংলাদেশের কালচারে মিশে আছে হাজার হাজার বছরের রাজা মহারাজা সম্রাট জাঁহাপনা কালচার। মহারাজের বিরুদ্ধে কিছু বললেই ছিলো শিরশ্ছেদের শাস্তি!
কিন্তু গণতান্ত্রিক দেশে কি তা দরকার আছে?
তাও তো এমন অফিসের কথা বলছিলাম, যেখানে ইনিয়ে বিনিয়ে বসের ভুল ধরে দিলেও, চাকরি চলে যায় না। কিন্তু এখন যদি সরকারি অফিসের দিকে তাকাই? সেখানে সবকিছু ঝিমিয়ে পড়েছিল এই এক ‘গুরুজনের মুখে মুখে কিছু বলা যায় না’ – মাইন্ডসেটের জন্যে!
আবার যদি পরিবারের দিকে তাকাই? কয়টা পরিবারে বাবা তার বাচ্চাদের কাছ থেকে criticism নিতে অভ্যস্ত? কয়টা পরিবার আছে যেখানে “My father knows best” এর বাইরে আমরা ভাবতে পারি?
আশার কথা হচ্ছে, কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ থাকেন। কিছু পরিবারে সন্তান ১৮-২০ হবার পর বাবা মা গুরুত্ব দিয়ে তাদের কথা শোনেন। কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও আছে। যাঁরা এর বাইরে ভাবতে শিখেছেন, শিখিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কারণেই অনেক বাংলাদেশি দেশে বা বিদেশে সুখী সমৃদ্ধ জীবন যাপন করছেন।
তাঁদের মত মানুষ আমাদের আরো দরকার।
যারা শুধু শোনাতে নয়, শুনতেও ইচ্ছুক। শুধু জানাতেই নয়, জানতেও ইচ্ছুক। শুধু বোঝাতেই নয়, বুঝতেও ইচ্ছুক। শুধু লিড দিতে নয়, ফলো করতেও ইচ্ছুক।
তাহলে এখন কি করণীয়ঃ
হবুচন্দ্র রাজা আর গবুচন্দ্র মন্ত্রীর বাইরে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা আজো শিক্ষকদের পা ধুইয়ে দিতে রাজি, কিন্তু তাকে যোগ্য শিক্ষক হতে হবে। ভণ্ড শিক্ষকদের জন্য অঢেল সম্মানদের দরজা বন্ধ।
[এখানে প্রশ্ন উঠে যাবে, ভণ্ড শিক্ষক কে? সেটার জন্যে আলোচনা হওয়া দরকার। আমার একার মতামত যথেষ্ট নয়।]
যদি কালচার উন্নত মানুষ হবার স্ট্র্যাটেজিকে খেয়ে ফেলে, তাহলে সেই কালচার আমাদের চাই না। গুরুজনের কথা শুনে শুনে গরীব দেশ হয়ে, উন্নত দেশের কাছ থেকে ফান্ড চেয়ে চেয়ে, মেগাপ্রজেক্টের প্ল্যান দেখিয়ে লোন নিয়ে নিয়ে দেশ কত দূরই বা আগাবে?
গুরুজনের ভালো আইডিয়া জুনিয়র নিবে। জুনিয়রের ভালো আইডিয়া সিনিয়র নিবে।
দেখেন, যুগে যুগে সেই মানুষগুলিই দ্রুত উন্নতি করে এসেছেন, যারা নিজে সিনিয়র দেখে জুনিয়রের ঠোঁট চেপে ধরেননি। তারা বেছে বেছে চালাক-চতুর, ভালোমানুষ জুনিয়র, এবং সিনিয়রদের সাথে সম্পর্ক রেখেছেন। আলোচনা করেছেন। নেপোটিজম ও পলিটিক্স কম – এমন ক্লাব বা গ্রুপগুলোতে জয়েন করেছেন।
নিজেকে মুক্তমনা রাখতে পারলে, নিজের ও আশেপাশের মানুষদের উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। নিজের জুনিয়রদের তাদের বুদ্ধিমত্তা প্রমাণের সুযোগ দিলে তা দোষের কিছু না। যে আপনার চাইতে পরে পৃথিবীতে এসেছে, তাই কিছু বিষয়ে, বিশেষ করে টেকনোলজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সে আপনার চাইতে আপডেটেড হবার কথা। এছাড়া, যে যে বিষয়ে তার দক্ষতা আছে, সেই বিষয়গুলোতে জুনিয়র কারো কাছ থেকে শিখলে আপনি ছোট হয়ে যাবে না।
আর যে সিনিয়র, তার আর কিছু না হলেও অভিজ্ঞতা আছে একটু বেশি। তার অপমর্যাদা না করে, তাঁর কথা শুনুন।
তবে বেছে বেছে সেই মানুষগুলিকে ফলো করুন, যারা সত্যিই জ্ঞানী। যারা সত্যিই আপনার ভালো চান। মানুষদের স্রেফ বয়সের ভার বিবেচনা করে তাঁদের পরামর্শকে মাথায় ওঠাবেন না। তাঁদের উপকার করতে কোন মানা নেই, এবং তাঁদের সাথে বেয়াদবি করারও কিছু নেই।
সবশেষে আবারো বলবঃ
আমরা বলছি না যে, শিক্ষক বা গুরুজনকে সম্মান করা ঠিক না। অবশ্যই তাঁদের, এবং পৃথিবীর সব পেশার মানুষকেই আমাদের ন্যূনতম মর্যাদা দিতে হবে। ইংরেজিতে যাকে বলে Dignity। এবং যাঁরা সম্মানজনক কাজ করে চলেন নিয়মিত, তাঁদের বাড়তি সম্মান দিতেই হবে।
সে হিসেবে অন্য কিছু পেশার চাইতে শিক্ষকতাকে বাড়তি সম্মান দেয়ার ব্যাপারটাও যুক্তিযুক্ত। সব প্রাচীন ধ্যানধারণা কিন্তু এক্সপায়ার্ড না। কিছু প্রাচীণ ধারণা সর্বদা সার্বজনীন। যেমন কেউ অন্যের কাছে সম্মান চাইলে, তাকে নিজেকে সম্মান করতে শিখতে হবে এবং অন্যকে সম্মান দেখানো শিখতে হবে – দুটোই দরকার।
কিন্তু যে শিক্ষক সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে শিক্ষার্থীদের ওপর জুলুম করছেন, তাকে আমরা ছেড়ে দিতে পারিনা। এর পরিণাম তাকে ভোগ করতেই হবে। শিক্ষকতা করা মানে যা খুশি তাই করার লাইসেন্স না। কারো চাইতে বয়সে বড় হবার মানেই তাকে যা খুশি তাই বলার লাইসেন্স পেয়ে গেছি – এমনটা ভাবা ঠিক না।
কিন্তু স্রেফ বয়স বা পেশার কারণে কারো কথা সাথে সাথে মেনে নিতে হবে – এমন ভাবে আমরা যাতে না চলি। সম্মান দিয়েই যুক্তিযুক্ত তর্কে প্রবেশ করতে পারি। এবং টক্সিক সিনিয়র, জুনিয়র, ও শিক্ষকদের সঙ্গ এড়িয়ে থাকতে পারি, যাদের কাছে উন্নত মানুষ হবার চাইতে প্রাচীণ ও এক্সপায়ার্ড ধ্যানধারণায় পড়ে থাকাই বেশি ভালো লাগে।
[বিঃদ্রঃ কানাডা, ইউকে, এবং বাংলাদেশে পড়াশোনার সুযোগ হবার কারণে, এই তিন জায়গার শিক্ষার ধরণ ও শিক্ষকদের আচরণের মিল ও পার্থক্য নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার পরিকল্পনা আছে। এবিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে জানাবেন।]